খুব সাবধানে সামলে চলুন সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল

বয়ঃসন্ধির সময়টা কৈশোর Puberty time পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের সময়। শরীরের সঙ্গে মনেও চলে দোলাচল, অকারণে হয় রাগ। সুতরাং কীভাবে সামলাবেন সন্তানের এই ইমোশনকে?

রাত্তিরে ডিনারের একটা ইনভিটেশন আছে। হাজব্যান্ডের অফিসের একটা ফরম্যাল পার্টি। ফুল ফ্যামিলি ইনভাইটেড। ঠিক সময়ে আপনি ড্রেস-আপ করে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই আপনার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল। আপনার ১৭ বছরের Puberty time ছেলে অলরেডি তৈরি হয়ে বসবার ঘরে অপেক্ষা করছে।

ফরম্যাল ড্রেসের বদলে তার পরনে ছেঁড়া ফাটা জিনস, টি-শার্ট এবং পায়ে নোংরা স্নিকার্স। সেটা পরে আর যাই হোক, ফর্ম্যাল পার্টিতে কখনওই যাওয়া যেতে পারে না। সুতরাং পরের ১৫ মিনিট আপনার কাটবে ছেলেকে বোঝাতে, যাতে সে পোশাকটা আপনার রুচি অনুযায়ী পালটায়। কিন্তু বৃথাই তাকে বোঝানো কারণ এরপরই নাটকের যবনিকা পতন, প্রচণ্ড জোরে দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজে। পার্টিতে আপনি গেলেন ঠিকই কিন্তু ছেলেকে ছাড়াই।

শুধু ছেলেরাই বা কেন, আপনার ১৩ বছরের মেয়ের কথাই ধরুন না কেন। বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে যাবে আপনার কাছে অনেকদিন আগেই পারমিশন নিয়ে রেখেছে। আপনিও সবদিকে খোঁজখবর নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন এবং আপনার কয়েকটি শর্তের কথাও মেয়েকে জানিয়ে দিয়েছেন। পৌঁছে ফোন করে দিও এবং মাঝেমধ্যে এক-দুবার আরও ফোন করে খবরাখবর জানিও। আর অবশ্যই পিকনিক থেকে ফেরার সময় ধার্য করে দিয়েছেন যেটা মানা মেয়ের জন্যে বাধ্যতামূলক।

মেয়েও আপনার সমস্ত শর্তে রাজি। এক্ষেত্রে মা-মেয়ের দ্বন্দ্ব থাকারই কথা নয় তাও পিকনিকের দিন সকালবেলায় আপনার মেজাজ খারাপ হল। বুঝলেন মস্ত ভুল করে ফেলেছেন, মেয়ের ড্রেসকোড নির্দিষ্ট করে দেননি। মেয়ের শর্ট ড্রেস আপনাকে ক্ষুব্ধ করল।

ড্রেসের লেংথ নিয়ে আপনার নিজস্ব মাথাব্যথা খুব একটা না থাকলেও রাস্তাঘাটে হিংস্র নেকড়ের অভাব নেই। এটাই আপনার মূল কনসার্ন। মেয়েকে ড্রেস চেঞ্জ করে পিকনিকে যেতে বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরো দৃশ্যপটের পরিবর্তন। চ্যাঁচামেচি, রেগে পা ঠোকা মেঝেতে, কান্নাকাটি এবং জোরে দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ।

এই দুটি দৃষ্টান্তই টিনএজ ছেলেমেয়েদের রাগের এবং প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকরাই এই সিচুয়েশনের সঙ্গে পরিচিত। টিনএজারদের রাগকে সামলানোর জন্যে বিশেষ মানসিকতার প্রয়োজন যা খুব কম মা-বাবার আয়ত্তে থাকে। বেশি সংখ্যক অভিভাবকরাই জানেন না যে, ঠিক কীভাবে এই ধরনের সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করবেন যা আজকের দিনে খুবই কমন।

বয়ঃসন্ধির সময়

কিশোর বয়সের একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে Puberty time অথবা যৌবনের প্রারম্ভে– দুটো পর্যায়কেই বয়ঃসন্ধির সময় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সময়টা একজন পুরুষ কিংবা নারীর জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ততটাই কমপ্লিকেটেড। শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার সময়। টিনএজার তখন না শিশু আর না প্রাপ্তবয়স্ক। কার্যক্ষেত্রে বহু জায়গায় তখন সে, নয় অন্যদের থেকে বড়ো অথবা এখনও ‘ছোটো’ রয়েছে বলে বিবেচিত হয়।

আগে সংযুক্ত পরিবারে, ছোটোদের মানসিক চাহিদার প্রয়োজন মেটাতে অনেক সদস্য উপস্থিত থাকতেন। এখন পরিবার ছোটো হয়েছে, সদস্য সংখ্যা কমেছে। ৩ অথবা ৪-এর বেশি নয়। তার ওপর অভিভাবকেরা দুজনেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চাকুরিরত। সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার কমিউনিকেশন গ্যাপ প্রচণ্ড। এছাড়াও বাড়ির বড়ো, ছোটো সকলেই নেট এবং মোবাইল স্যাভি। একে অপরের সঙ্গে বসে কথা বলার সময়, সুযোগ নেই বললেই চলে।

সুতরাং এই পরিস্থিতিতে এবং এই টিনএজ বয়সটাতে বাচ্চাদের যেখানে মা-বাবার সহযোগিতা সবথেকে বেশি কাম্য, সেখানে এটার অভাব তাদের অসহিষ্ণুতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাদের মধ্যে বিদ্রোহ ভাব কাজ করে। চিরাচরিত যে পথ তাদের অনুসরণ করা উচিত বলে সকলে মনে করে, তার ঠিক বিপরীত পথ তারা বেছে নেওয়া স্থির করে। তারা অত্যন্ত অ্যাগ্রেসিভ, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হয়ে ওঠে এমনকী মা-বাবার দেওয়া শিক্ষার রাস্তায় চলতেও তারা অস্বীকার করে।

তাদের এই মানসিক অবস্থায় ক্রমাগত বড়োদের শাসন এবং প্রতি পদক্ষেপে তাদের সঙ্গে সমবয়সীদের কাজের এবং চরিত্রের তুলনার মানসিকতা, টিনএজারদের আরও বেশি করে সমস্যার সম্মুখীন করে তোলে। ক্রমাগত বকাঝকা টিনএজাররা বরদাস্ত করতে পারে না কারণ তারা নিজেদের যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক বলেই গণ্য করে এবং মনে করে যে-কোনও কঠিন কাজও তারা সহজেই করে ফেলতে পারে। সুতরাং বড়োদের উচিত, প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই টিনএজ সন্তানকে সম্মান করা। তারা বড়োদের কাছে সম্মান পেলেই বুঝতে পারবে তাদেরও বড়োদের প্রতি কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করতেও পিছপা হবে না। সুতরাং প্রতি ক্ষেত্রে তাদের কাজের সমালোচনা করলে তারাও বিমুখ হয়ে পড়বে বড়োদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করতে।

সম্প্রীতি রক্ষার্থে তাই সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের প্রতিদিন কমিউনিকেট করা একান্ত প্রয়োজনীয়। এমনভাবে ওদের সঙ্গে কথা বলুন যাতে ওদের কখনওই মনে না হয় যে, আপনি অনধিকারচর্চা করছেন অথবা ওদের জীবনে অলিখিত দখল নিতে চাইছেন। আপনি যে সত্যিই ওদের ভালোমন্দের জন্যে চিন্তিত সেটা আপনার ব্যবহারে প্রমাণ করুন। মৃদু ভাষণে আপনার ইচ্ছা, অনিচ্ছা সন্তানের কাছে প্রকাশ করুন। জোর করে নিজের ইচ্ছা ওদের উপর চাপাবার চেষ্টা করবেন না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আপনি হয়তো সন্তানের কোনও ব্যাপারে কোনওদিনই তেমন মাথা ঘামাননি। অথচ হঠাৎ একদিন সন্তানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে সামনে বসিয়ে, তার পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে জানার চেষ্টা যদি করেন, তখন দেখবেন আপনার আশা অনুযায়ী সঠিক উত্তর সন্তানের থেকে পাচ্ছেন না।

শিশু বয়স থেকেই সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে বয়সের ব্যবধান হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের, আপনার কাছে কনফাইড করতে অসুবিধা না হয়।

দিনের শেষে অভিভাবকদের উচিত, সন্তানের সঙ্গে বসে সারাদিনের উভয়ের কর্মব্যস্ততার ডিটেল্স আলোচনা করা। টিনএজ সন্তানকে বোঝাতে হবে যে সে প্রাপ্তবয়স্ক হতে চলেছে সুতরাং সামাজিক কিছু দায়িত্ব তার উপরেও বর্তায়। অভিভাবক হিসেবে কিছু কথা মাথায় রাখতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, শৈশব পেরিয়ে Puberty time তারা যৌবনে পা দিতে চলেছে সুতরাং কিছু অভ্যাস এবং জীবনের প্রতি তাদের মূল্যবোধ, ভবিষ্যৎ জীবনে পা রাখতে তাদের নানা ভাবে সাহায্য করবে। হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলা তাদের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় সেটা ধীর স্বরে বুঝিয়ে বলা বাঞ্ছনীয়। শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে খেলাধুলোতেও তাদের প্রেরণা যোগানো উচিত।

সন্তানের সঙ্গে সহযোগিতার সমস্ত রাস্তা খোলা রাখতে হবে যাতে সন্তানের প্রয়োজনে সহজেই মা-বাবা তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। সন্তানকেও তার প্রাপ্য স্বাধীনতা দেওয়া খুবই দরকার। যাতে প্রয়োজন পড়লে নিজের মতো করে যে-কোনও অসুবিধার অথবা সমস্যার মীমাংসা করতে তার দ্বিধা না-হয়। অভিভাবক মানেই সন্তানের মাথার উপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা না বরং তাদের প্রয়োজনীয় জায়গা ছেড়ে দেওয়া। যাতে দায়িত্ববান প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে তারা নিজেদের পরিচয় গড়ার সুযোগ পায়।