কুমিল্লায় গড়ে উঠেছে উন্নত জাতের আফ্রিকান ডরপার জাতের ভেড়ার খামার। বিশ্বের সেরা জাতের এই ভেড়াগুলোর প্রতিটির ওজন হয়ে থাকে ৮০ থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত। বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, এই ভেড়াগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। আফ্রিকার বংশ বলে খুবই অল্প পানি এবং অল্প খাদ্য খেয়েও জীবন যাপন করতে পারে। শুকনা লতাপাতা, ঘাস, খড় ইত্যাদি এবং যেকোনো খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারে।
এজন্যেই সারাবিশ্বে এই ভেড়ার জাতটির কদর সবচেয়ে বেশি। এই ভেড়াগুলো যেকোনো পরিবেশে, যে কোন স্থানে থাকতে পারে। খুবই কষ্ট সহিষ্ণু জাত বলে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পরিবেশে এদের কদর বেশি। এই ভেড়া খুবই অল্প সময়ে, খুবই তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। শীতপ্রধান দেশ থেকে শুরু করে মরুভূমি পর্যন্ত সব জায়গায় এবং পৃথিবীর সব দেশেই এই ভেড়া চাষ করে সফলতা অর্জন করেছে। ফলে পর্যায়ক্রমে আস্তে আস্তে বিশ্বের সমস্ত দেশেই এই ভেড়ার জাতটি ছড়িয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশেও বেশ কয়েক বছর যাবৎ এই ভেড়ার জাতটি আমদানি করে, খামার পর্যায়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। অল্প সময়ে ব্যাপক সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে খুবই সহজে মানিয়ে নিয়েছে ভেড়ার এই জাতটি।
এখন বলা যায়, এই জাতটি মাংস উৎপাদনকারী পশুর তালিকার প্রথমে চলে আসবে বলে মনে করা হয়। আজ এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনাদের জানাবো, আমাদের দেশে এই ভেড়া পালনের সফলতা অর্জনকারী একজন সফল খামারির কথা। যিনি ভালো ও প্রাকৃতিক পরিবেশে খামার করার জন্য ঢাকার বাড্ডার খামার ছেড়ে দিয়ে কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রামে চলে গিয়ে, এই আফ্রিকান ভেড়া লালন পালন শুরু করেন।
জনাব শাহ আলম কুমিল্লা জেলায় হোমনা থানার বাবরকান্দি গ্রামে ১৮ শতাংশ জমি কিনে খামারটি শুরু করেন। তিনি ঢাকার বাড্ডায় ভাড়া করা খামারে, প্রথমে ৪০ টি গাড়ল জাতের ভেড়া কিনে লালন পালন শুরু করেন। কিন্তু দেখা যায়, এর বাজার মূল্য কম থাকায় এবং খাদ্যও বেশি লেগে যেত। ঢাকার ভিতরে ছিল খামারটি তাই খাবার দিয়ে লাভ হচ্ছিল না। কাঁচা ঘাসও ভালো পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। যার ফলে পুরো খামারটি দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়াও পাঠাগুলো খুবই গোতাগোতি করত। যার ফলে পেগনেন্ট অবস্থায় অনেক মা গাড়লের বাচ্চা মারা যেত। যা অবশিষ্ট জন্ম হতো, তা দিয়ে তেমন পুষিয়ে যাচ্ছিল না।
এছাড়াও দানাদার খাবারের অতিরিক্ত মূল্যে কিনে গাড়ল লালন পালন করে, যে পরিমাণ বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছিল তা দিয়ে তেমন লাভ হচ্ছিল না। প্রতিটি গাড়লের বাচ্চা খামার থেকে বিক্রি হচ্ছিল মাত্র ৫ হাজার ৬ হাজার টাকায়। পরবর্তী সময়ে তিনি ৪০ টি গাড়ল ভেড়া কিছু লস দিয়ে, একসাথে বিক্রি করে দেন এবং আরো কিছু টাকা জোগাড় করে আফ্রিকান উন্নত জাতের ডরপার ভেড়া, একজন আমদানিকারক এর মাধ্যমে কিনে আনেন।
জনাব শাহ আলম জানান, খামার করে সময় নষ্ট করে যদি লাভই না হয়, তাহলে সেই খামারটি ধরে রাখার প্রয়োজন কি ? এই চিন্তা থেকেই তিনি খামারের গাড়লগুলোকে বিক্রি করে, আফ্রিকান উন্নত জাতের ডরপার ভেড়া আমদানি করে আনেন। তিনি জানান, আমদানিকারকের মাধ্যমে প্রথমে ২০টি ভেড়া আমদানি করেন।
শুধুই দেখার জন্য যে, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এই জাতটি উপযুক্ত কিনা বা বংশবিস্তার হয় কিনা। তারপর পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, যেকোনো পরিবেশে থাকতে পারে এই ভেড়াগুলো। যেকোনো অল্প খাবার খেয়েও বাঁচতে পারে। শুকনা লতাপাতা, অল্প খাবার, অল্প পানি খেয়েও বাঁচতে পারে এবং ছয় মাস পরে দেখা গেলো চারটি বাচ্চার জন্ম হয় একসাথে। এতে শাহ আলম এর মন ভরে যায়, মনে আনন্দের উল্লাস বইতে শুরু করে। তিনি বুঝতে পারেন, এই জাতের ভেড়া বাংলাদেশের জন্য খুবই উপযোগী।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকার ভিতরে আর খামার করবেন না। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে ঘাস এবং চারণভূমি পাওয়া যাবে, সেখানেই খামারটি গড়ে তুলবেন। তিনি কুমিল্লায় একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাত্র ১৮ শতাংশ জমি কিনে নেন। এখানে টিন দিয়ে শ্যাড তৈরি করে, ভেড়া পালতে শুরু করেন। যেহেতু জায়গাটি খালি জমি ছিল, তাই সম্পূর্ণ খামার শুরু করতে একটু সময় লাগছে। ইতিমধ্যে একটি বিল্ডিং ঘর তৈরি করেছেন। পাশের একটি জায়গার মধ্যে টিনশেড দিয়ে ভেড়ার জন্য জায়গা করে দেন। সেই সাথে পর্যায়ক্রমে খামারটি উন্নয়নের কাজ চলছে।
কুমিল্লায় খামারটি স্থানান্তরের পর আরো ৭০টি আফ্রিকান ডরপার জাতের ভেড়া কিনে নিয়েছেন। নতুন খামারে স্থানান্তরের পর গত চার মাসে ৩০টি নতুন বাচ্চার জন্ম হয়েছে। বর্তমানে খামারটিতে ১২০টি ডরপার জাতের ভেড়া রয়েছে। যেহেতু খামারটি নতুন তৈরি করা হচ্ছে, এখানে বেশ খরচ হচ্ছে, ফলে খামার থেকে ২৪ টি ভেড়ার বাচ্চা বিক্রি করে দেন।
বাচ্চাগুলো বিক্রি করেন ৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। এছাড়াও আরও তিনটি বড় পাঠা বিক্রি করেন ৩ লাখ টাকায়। এমন কিছু ব্যক্তি আসেন কিনতে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী যাদের কাছে বিক্রি না করে পারা যায় না। ফলে বাধ্য হয়েই কিছু বাচ্চা ও পাঠা ভেড়া বিক্রি করে দেন। এছাড়াও কিছুটা টাকারও প্রয়োজন ছিল, তাই অনেকটা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
বর্তমানে ৫০ টি ভেড়া প্রেগনেন্ট অবস্থায় আছে। আগামী দেড় মাসের ভিতরে ৫০ টি নতুন বাচ্চার জন্ম হবে, এই খামারে। প্রশ্ন করা হলে, যদি কেউ খামার করতে চান বা শখ করে দু’একটি পালতে চান, তাহলে কি আপনি ভেড়া বিক্রি করবেন ? তিনি জানান, এই খামারটি করা হয়েছে মূলত কমার্শিয়াল চিন্তা ভাবনা থেকে। তবে যেহেতু ভেড়াগুলো বিদেশ থেকে অনেক দাম দিয়ে আমদানি করা হয়েছিল, তাই তিনি রিটার্নও চান তাড়াতাড়ি। যদি ভালো মূল্যপান, টাকা-পয়সার ওতো একটা ব্যাপার রয়েছে। তাহলে তিনি অল্প পরিমাণ বিক্রি করতে পারবেন। তবে এখন নয়, বাচ্চা হওয়ার পর । যখন বাচ্চাগুলোর বয়স ছয়-সাত মাস হবে তখন।
জনাব শাহ আলী জানান, এতদিন শুধু খামার করেছি, লাভের মুখ দেখতে পারেনি। এখন মোটামুটি বলতে পারি, লাভের পরিমাণ দেখতে শুরু করেছি, সেটা ভালোভাবেই পারছি । তিনি এই খামারটিকে অনেক বড় করতে চান। তিনি মনে করেন, এই বিদেশী আফ্রিকান জাতের ডরপার ভেড়ার খামার অনেক বড় করতে পারবেন। কারণ এই খামারগুলো আমাদের পরিবেশের সাথে সম্পূর্ণভাবে খাপ খেয়ে চলতে পারছে।
ভালো মানের বাচ্চারও জন্ম হচ্ছে, আবার খাবারও খুব কম লাগে। যার ফলে লাভের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। এছাড়াও এই ভেড়াগুলো যেকোনো খাবার অল্প পরিমাণ খেয়েও বাঁচতে পারে। তিনি এই খামার করে বাংলাদেশের মানুষকে দেখাতে চান এবং বিশ্ববাসীকেও দেখাতে চান। তিনি সবাইকে অল্প পরিমাণ জায়গার মধ্যে বিশাল আকারের খামার করে দেখাতে চান। কিভাবে অল্প পরিমাণ জায়গার মধ্যে অনেক বড় খামার করা যায় এবং লাভ করে টিকে থাকা যায়।
তথ্যসূত্রঃ নিলান্ড ডট কম